Sunday, January 2, 2011

বনলতা আমার মায়াদর্পণ

ম ই নু দ্দী ন খা লে দ
বনলতা আমার মায়াদর্পণ



কী করে দেখা হলো বনলতা সেনের সঙ্গে ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে! এখনও সে কথা গভীর বিস্ময়ে ভাবি। এরই মধ্যে কুড়ি কুড়ি বছর হয়ে গেছে পার। এখনও আঁকা আছে মনে তার ছবি। নিকুঞ্জ থেকে বেরিয়ে এসে যেমন পুষ্পিত লতা ঝুলে থাকে, হাওয়ায় দোলে, তেমন তার নরম কেশের দাম চোখের ধার বেয়ে মসৃণ ত্বকের গ্রীবা ও কাঁধ ছুঁয়ে থোকা থোকা ঝুলে ছিল। ললিত কেশদামের ভেতর দিয়ে বনলতা আনত চোখে আমাকে দেখেছিল। কৈশোরের অমল সবুজ নরম মন নিয়ে যখন যৌবনের উপকণ্ঠে পেঁৗছেছি তখনই বনলতাকে নিয়ে ময়মনসিংহের এক নিভৃত গ্রাম মহেশপুরে চলে আসি। তখন শীত ঋতু ছিল, হয়তোবা হবে বসন্ত; এই গোল পৃথিবীতে আরও বহুকাল কেটে গেছে; সব কথা ঠিক মনে নেই। পুকুরঘাটে গাঙের পাড়ে অথবা বাড়ির আঙিনা ছেড়ে অদূরে মাঘের রিক্ত ধানক্ষেতের পাশে আমরা বসেছি দু'জন।
ললিত রেখায় বনলতার মুখ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়। সিগনেট প্রেসের বই। তবে আমি যে 'বনলতা সেন' পেয়েছিলাম রেলস্টেশনের বইয়ের দোকানে তা কোনো দস্যু-সংস্কারণ হবে। সিগনেটের বইটা বটতলার ছাপাখানার মতো কোনো প্রেস ছেপে থাকবে।
ইশকুল জীবন তখনও শেষ হয়নি। বনলতা সেনের তিরিশটি কবিতা পড়তে পড়তে ঘর থেকে মাঠে যাই_ মাঠ থেকে ঘরে ফিরে আসি। জীবনানন্দ এক সম্মোহনের বলয়ে আমাকে অন্তীরণ করে রাখে। কী এক কুহক আমাকে মন্ত্রচালিতের মতো টেনে নিয়ে চলে। লেখার চেষ্টা করি; কিছু একটা বলতে চাই। দেখি আমার গভীরে বনলতা বসে আছেন। আমি কথা বলতে পারি না। আমার নিজস্ব কোনো কণ্ঠস্বর নেই। আমার হয়ে কথা বলেন বনলতা সেনের কবি। আরও পরে জেনেছি, যারাই পড়েছে বনলতার মায়াপাশে তারা আর বহুকাল সেই মায়াপাশ থেকে নিজকে মুক্ত করতে পারেনি। নিজের বাড়ি খুঁজে পেতে তাদের অনেক ঢুঁড়ে ফিরতে হয়েছে। জীবনানন্দের কবিতার নিশি পাওয়া পথে বনলতার সঙ্গে আমি আজও হেঁটে চলেছি। কখনও চৈত্রের হাওয়ায় সাদা বকের মতো বাতাসে দুলে দুলে অনন্তে হারাই, কখনও বনহংসী দম্পতির মতো কামনার টানে কাদা-জলমাখা পৃথিবীতে ফিরে আসি। লেখতে জানি না। তবুও জীবনে সৃজনের ঘোর আসে। আমি দ্রুতবেগে নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে সহসা জীবনানন্দীয় কক্ষপথ ভেদ করে অতীন্দ্রিয় আলোয় জ্বলে উঠি। বোধ ও বোধির নিগূঢ় পথ সন্তর্পণে হেঁটে এসে আমি আজও আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরি বনলতাকে। জীবনানন্দ আমার মায়াদর্পণ। মাঝে মাঝে দেশ ছেড়ে বহুদূর চলে যাই। এই গোল পৃথিবীর বিপরীত মেরুতে গিয়ে যখন একা হয়ে যাই আর নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলি, তখনও কারও অলৌকিক ইঙ্গিতে সেই মায়াদর্পণ আমার মুখের কাছে চলে আসে।
কৈশোর থেকেই বুঝেছি যে, আমার কবির মতোই আমি ক্লান্তপ্রাণ_ বেদনার সন্তান_ আমার বাড়ি বিষাদপুরে। প্রথম কবিতাই আমাকে ইতিহাসের দীর্ঘপথে চালিত করে সময়ের নতুন সংজ্ঞা মগজের কোষে ঢুকিয়ে দিল। ইতিহাসের পথ যেখানে শেষ আর প্রাগৈতিহাসিক কাল শুরু, সেখানেও আমি আমাকে খুঁজে পেলাম। পৃথিবীর তিনভাগে জল আমি এক অনাদি নাবিক হয়ে গেলাম। বনলতা সেন কবিতাটির পঙ্ক্তিগুলো মস্তিষ্কের টর্চ লাইটের তীক্ষষ্ট রশ্মিতে পরখ করে দেখি কী সব আশ্চর্য ছবি। সাগর পাড়ের দূর অতীতের সভ্যতার ভগ্নস্তূপ থেকে অতর্কিতে বনলতা সেন নামের এক নারী আবির্ভূত হয়ে নাবিকের হাজার বছরের ক্লান্তি ঘুচিয়ে দেয়। বহুপথ পাড়ি দেওয়া জাহাজের মতো ক্লান্ত নাবিকের জন্য দারুচিনি দ্বীপে অপেক্ষমাণ ছিল সেই নারী। কোথায় বিম্বিসা আর অশোকের কাল, কোথায় বিদর্ভ, বিদিশা, শ্রাবস্তীর মতো ইতিহাসখ্যাত নগর আর তারই পাশে আচমকা উঠে এলো নাটোর আর এই মফস্বল শহরের বাসিন্দা বনলতা সেন। বোধের কী অপূর্ব জাদুবলে মহাভারতের সভ্যতার পথ থেকে আচমকা সরে এসে কবি ঘনিষ্ঠতার বলয় তৈরি করলেন নাটোরের বনলতা সেনকে কবিতার তিনটি স্তবকেরই শেষে উচ্চারণ করে। শেষে শিশির পড়ার দুয়েকটা শব্দ দিয়ে সন্ধ্যার নীরবতা নামালেন কবি। বিমূর্তকে মূর্ত করার জন্য চিলের ডানায় রৌদ্র এবং রৌদ্রের গন্ধ লেগে থাকার কথা বললেন তিনি। তারপর রাত্রি নামল। দিনের পাণ্ডুলিপি লেখা শেষ হলে অন্ধকারে স্পেসে জোনাকিরা আলো দিয়ে নতুন গল্প লেখা শুরু করল। সেই অন্ধকারে সাগর পাড়ের অতীত সভ্যতার দরদালানের মতো জেগে রইলেন বনলতা সেন। সব আলো নিভে গেলেও বনলতা নামে এক প্রদীপ গহন নিভৃতিতে জ্বলতে থাকে। এ কবিতা পড়ার পর বর্ণনারীতি বা ন্যারেটিভ সম্পর্কে নতুন বোধোদয় হলো আমার। কবিতা কখনও ধারাবাহিক বর্ণনা নয়। পারম্পর্য রক্ষা করে চলা তার স্বভাব নয়; উল্লম্ফন বা অতর্কিত পরস্পরবিরোধী অনুষঙ্গের সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই নানা উপলব্ধিতে আকীর্ণ মন যেটুকু উছলে দেয় সেটুকুই কবিতা।
পরের কবিতা 'কুড়ি বছর পর'। এখানেও শেষে সন্ধ্যা নামে এবং এক তুমি থাকে বনলতার সমার্থক হয়ে। 'সোনালি সোনালি চিল_ শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে_'। শিশির দিয়ে সোনালি চিল শিকারের প্রসঙ্গ টেনে জীবনের সোনালি পর্বের সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন। সোনালি শব্দটি দু'বার উচ্চারণ করে কবি ফুরিয়ে আসা জীবনের গোঙানি করুণতর করে তুলেছেন। শব্দকে বাজিয়ে স্বর ও সুরের পর্দা তৈরি করে কবিতায় যে সঙ্গীত সৃষ্টি হয় তাও আমি গভীরভাবে অনুভব করি জীবনানন্দ পড়ে।
'আমি যদি হতাম' কবিতায় দু'বার বন্দুকের গুলি ছোড়ার মধ্য দিয়ে আমি পুরো জীবনকে অনুভব করলাম বনহংসীর মতো। এ কবিতার গল্পটা আমি ভেঙে পাঠ করি। প্রথমে বনহংস ও বনহংসীর শবের বনে পার্থিব জীবন। তারপর রাত। আকাশে চাঁদ। তাদের নক্ষত্রখচিত স্বপ্নময় আকাশ ডাকে। প্রেমার্ত হংসযুগল আকাশে ডানা ভাসায়। পরের স্তবকে তারা তারাভরা নীল আকাশের অনন্ত বাসরে আলিঙ্গনবদ্ধ হয়। একজন অনুভব করে অন্যের রক্তের উষ্ণতা। এখানেও কবি শব্দের নিপুণ প্রয়োগে আলিঙ্গনের অপূর্ব জ্যামিতিক হিসাব দিয়েছেন। তৃতীয় স্তবকের শুরুতে বলা হচ্ছে, 'তোমার পাখনায় আমার পলক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন_'। দু'জনের পাখনা ও পালকের সরাসরি বিনিময়ে কবি সঙ্গমের মর্মার্থ জানান দেননি। একজনের পালক স্পর্শে অন্যের রক্তের স্পন্দন বেগবান করার কথা বলেছেন।
সেই সোনালি ফুলের মতো তারাভরা আকাশে যখন বনহংস ও হংসী স্বপ্নে বিভোর হয়ে যুগলবন্দি দেহে ভাসছে তখনই শিকারি তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলির শব্দে যুগলের গতি তির্যক হয় এবং তারা মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায়। এখানে বন্দুকের অনুষঙ্গ কবি যোজিত করলেন হংসযুগলের ডানায়। বন্দুকের শব্দ শুনেই হংসযুগল বলে ওঠে, 'আমাদের পাখায় পিসটনের উল্লাস।' যন্ত্রের ক্ষিপ্রতা আর পাখির ডানার গতি কী এক অভূতপূর্ব নিয়মে অদল-বদর হয়ে গেল। কবিতার শেষ স্তবকে দ্বিতীয়বার গুলির শব্দ শোনা গেল। এবার শিকারির গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না। যে জলসিঁড়ি নদীপাড় থেকে হংসযুগল জীবন শুরু করেছিল, সেখানেই তারা ভূপাতিত হলো। প্রেম পেয়ে মৃত্যুবরণ করার মধ্য দিয়ে জীবনের পূর্ণতা আছে। তাই গুলিবিদ্ধ মৃত্যুপথযাত্রী হংসযুগল বলে, 'আমাদের স্তব্ধতা,/আমাদের শান্তি।' দুটি গুলির শব্দের শৈল্পিক প্রয়োগে হংসযুগলের ঘটনা নিয়ে আমি একবার চলচ্চিত্র বানানোর কথা ভেবেছিলাম। এক গুলির শব্দ জীবনকে অনুভব করায় জীবনের স্বপ্ন ব্যাপ্ত পরিসরে ডানা মেলে আর আরেক গুলির শব্দ প্রাপ্তির সমাপ্তি ঘোষণা করে।
'নগ্ন নির্জন হাত'_ এ কবি আবারও সমুদ্র পাড়ে দাঁড়িয়ে বিলুপ্ত নগরীর ঘ্রাণ নিতে নিতে অবচেতনাকে জাগিয়ে তুললেন। তাই চিত্র এলো খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে। কখনও দালানের ভগ্নাংশ, কখনও প্রাসাদের অভ্যন্তরের কারুকাজ ও আসবাবপত্রের টুকরো-টাকরা চিত্র ভেসে আসল। কমলা রঙের রোদের মধ্যে পায়রা ও কাকাতুয়ার বিচরণ, মেহগনির ছায়ার মায়ায় জেগে উঠল অতীতের কথকতা নির্জ্ঞানলোক। রামধনু রঙের কাচের জানালা, হরিণ ও সিংহের ছালের পাণ্ডুলিপি আর লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ অবচেতনের ধূপ উস্কে দিল যেন। এক অভাবিত আবহ তৈরি হলো। এবার বনলতা আবক্ষ দেহে আর উপস্থাপিত হলেন না।
অকস্মাৎ এক গেলাস লাল তরমুজ মদ নিয়ে এক নগ্ন-নির্জন হাত প্রসারিত হলো। কেউ সশরীরে স্বাভাবিক নিয়মে এলো না। 'তোমার নগ্ন-নির্জন হাতই কবিতার শেষ দুই চরণ। চরণটি একবার শেষ স্তবকের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, আরেকবার তা স্তবক বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্তিম চরণ হিসেবে উচ্চারিত হয়েছে। লুপ্ত সভ্যতার মধ্য থেকে আচমকা নগ্ননির্জন হাতে ধরা লাল মদের গেলাস উত্থিত হওয়ার দৃশ্যেই বোধহয় আমি প্রথম পরাবাস্তব শিল্পের স্বাদ পেয়েছি।'
তারপর এই স্বাদ পেয়েছি 'হাওয়ার রাত' কবিতায়। এখানে স্বপ্নের ঘোরে মশারি সাদা বকে রূপান্তরিত হয়ে স্বাতী তারার পাশ দিয়ে নীল সমুদ্রের ওপরে ভেসে যায়। কবির পরাবাস্তব চৈতন্য আরও বিধুর ইমেজ আবিষ্কার করে 'বেড়াল' কবিতায়। এখানে হৈমন্তিক সন্ধ্যার জাপরান রঙের নরম সূর্যকে নিয়ে একটি সাদা বেড়াল খেলা করে। সূর্যের রশ্মি ফুরিয়ে গেলে সেই বেড়ালই থাবা উঁচিয়ে গোল গোল কালো বল ছড়িয়ে দিয়ে অন্ধকার ঘনিয়ে তোলে।
জীবনানন্দের কবিতা মানে আমার কাছে প্রত্নভূমিতে দাঁড়িয়ে বিলুপ্ত কোনো নগরীর কারুকাজমণ্ডিত প্রাসাদের বিভিন্ন কুঠুরি অবাক বিস্ময়ে পাঠ করে চলা। সেসব কুঠুরিতে দেখি হীরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস হাসে। সুদর্শনা, অরুনিমা স্যানাল, সবিতার সঙ্গে দেখা হয় অন্তরঙ্গ পরিধিতে। বহুকাল বয়ে গেল। তবু আজও আমার সিথানের পাশে বসে আছেন বনলতা সেন।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা সিটি কলেজ
Source: Daily Samakal, 24th Feb, 2010

No comments:

Post a Comment