Monday, January 3, 2011

থাকে শুধু বনলতা সেন

থাকে শুধু বনলতা সেনএ পৌষেই পুরো হলো 'বনলতা সেন' কবিতা প্রকাশের ৭৫ বছর। আজও অম্লান তুলনাহীনা এই নারীর সৌন্দর্য। বাংলা কবিতার এই মোনালিসাকে ঘিরে জন্ম নিচ্ছে কত কত রহস্য। বনলতা সেন নামে সত্যিই কি ছিলেন কোনো নারী? আজ স্পটলাইটজুড়ে থাকল এই চিরসুন্দরীকে বোঝার চেষ্টা সৈকত হাবিব বাংলা ভাষার ইতিহাসে এত জনপ্রিয় কবিতা কি আছে আর? বনলতা সেনের মতো? কবিতাটি প্রকাশের পর তরুণ পাঠকদের এমনভাবে আকৃষ্ট করেছিল, যাতে কবি নিজেও বিস্মিত হয়েছিলেন। ৭৫ বছর ধরে কবি ও সাধারণ পাঠকের কাছে সমান জনপ্রিয় এমন কবিতা বাংলা ভাষায় খুব বেশি নেই।
কিন্তু কেন এই জনপ্রিয়তা? হয়তো কবিতাটির নাটোরের নায়িকা স্বয়ং। আবার কবিতার রহস্যময়তাও কারণ হতে পারে। কবি-লেখক-সমালোচকরা কতভাবেই না কবিতাটিকে ব্যাখ্যা করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন এর নায়িকা ও কবির স্বরূপ! কত না প্রক্রিয়ায় উন্মোচন করতে চেয়েছেন রহস্য!
একনিষ্ঠ জীবনানন্দ-গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ সম্পাদিত 'জীবনানন্দ দাশ: পাণ্ডুলিপির কবিতা-২' অনুসারে 'বনলতা সেন' কবিতাটির রচনাকাল ১৯৩৪ সাল। তবে বনলতা নামটি জীবনানন্দ কিন্তু প্রথম কাব্যে ব্যবহার করেননি। ১৯৩৩ সালে লেখা 'কারুবাসনা' উপন্যাসেও বনলতা ছিল। অন্যান্য কবিতার মতো 'বনলতা সেন' কবিতাটিকেও জীবনানন্দ বারবার পরিমার্জনা করেছেন। আদি খসড়ার সঙ্গে বর্তমান কবিতাটি মিলিয়ে পড়লে অবাকই হতে হয়_'শেষ হল জীবনের সব লেনদেন/বনলতা সেন।' পরিমার্জিত কবিতাটি ১৯৩৫ সালের ডিসেম্বরে বুদ্ধদেব বসুর 'কবিতা' পত্রিকায় ছাপা হয়।
সে সময় বুদ্ধদেব বসুর কবিতাভবন থেকে 'এক পয়সায় একটি' নামে কবিতা পুস্তিকার সিরিজ প্রকাশ হতো। সেখান থেকে সেকালের প্রায় সব খ্যাতিমান তরুণ কবির বই প্রকাশ হয়েছে। এই সিরিজের আওতায় ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশ হলো বই 'বনলতা সেন'। তবে প্রকাশকের জায়গায় ছিল জীবনানন্দের নাম। বইটির প্রুফ দেখে দিয়েছিলেন কবিতাভবনের প্রতিষ্ঠাতা বুদ্ধদেব বসু। ১৬ পৃষ্ঠার সেই বইটিতে ছিল মোটে ১২টি কবিতা। জীবনানন্দের বইটি তেমন পছন্দ হয়নি। তাই দুই বছর পর ১৯৪৪ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত নতুন কাব্যগ্রন্থ 'মহাপৃথিবী'তে স্থান পায় 'বনলতা সেন'। কিন্তু এতেও তৃপ্ত হলেন না কবি। আট বছর পর ১৯৫২ সালে 'বনলতা সেন' পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়ে তার যাত্রা সম্পন্ন করে। এটি প্রকাশ করে সিগনেট প্রেস। আগের ১২টির সঙ্গে যোগ করা হয় নতুন ১৮টি কবিতা। এ বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। এ বইটিই 'বনলতা সেন'-এর পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশেষ সংস্করণ। এখন বাজারে 'বনলতা সেন' নামে যে বইটি পাওয়া যায়, এটি এই সংস্করণেরই প্রতিলিপি।
বনলতা সেনের সমালোচকের অভাব হয়নি। সুকুমার সেন, দীপ্তি ত্রিপাঠী, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ক্লিনটন বি. সিলি, হরপ্রসাদ মিত্র, জগন্নাথ চক্রবর্তী এ রকম অনেকে কবিতাটির উচ্চকিত প্রশংসা করেন। এমনকি যারা জীবনানন্দ দাশকে 'দুর্বোধ্য কবি' হিসেবে চিহ্নিত করতেন, সেই সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দেরাও এই কবিতা সম্পর্কে কোনো অভিযোগ তোলেননি। তাই বলে কি এই কবিতার বিরুদ্ধাচার হয়নি? হয়েছে। সেকালের সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মণীন্দ্র রায়, রঞ্জিৎ সিংহ, পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়, আলোক সরকার এই কবিতার বিরুদ্ধে তীর ছুড়তে পিছপা হননি। এমনকি 'বনলতা সেন' কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও হয়েছে। এতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন 'শনিবারের চিঠি'র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। বনলতা সেন কবিতাটি নিয়ে 'শনিবারের চিঠি'তে ছাপানো হয়েছে এমন লেখাও_"এই প্রতিভাবান কবিদের আর একটি কৌশল_কবিতা লিখিতে লিখিতে অকস্মাৎ অকারণে এক একজন ভদ্রলোকের মেয়ের নাম করিয়া আমাদিগকে উৎসুক ও উৎসাহিত করিয়া তোলেন।...ইহার সূত্রপাত হইয়াছে নাটোরের 'বনলতা সেন'কে লইয়া।" (শনিবারের চিঠি, বৈশাখ ১৩৪৪)। পরে জীবনানন্দ দাশের আকস্মিক মৃত্যুর পর অবশ্য সজনীকান্ত 'শনিবারের চিঠি'তে তাঁর প্রশংসাই করেছিলেন।
একটি কথা প্রচলিত, মার্কিন কবি এডগার অ্যালান পো-র 'টু হেলেন' কবিতা থেকে প্রভাবিত হয়ে 'বনলতা সেন' লিখেছেন জীবনানন্দ। কেউ কেউ অন্য ইংরেজ কবিদের সঙ্গেও মিল পেয়েছেন, যেমন_কিটস। বিষ্ণু দের করা ভাষান্তর থেকে 'টু হেলেন'-এর একাংশ_'হেলেন, তোমার রূপ মোর মনে হয়/ সেকালের ভিনীসীয় তরণীর মতো,/সুগন্ধ সমুদ্রবক্ষে শান্তধীরে বয়/ক্লান্ত প্রবাসীকে দীর্ঘপথশ্রমাহত/আপন স্বদেশে সমাগত।...' কিন্তু 'বনলতা সেন'-এর মধ্যে যে নিবিড়তা রহস্যময়তা, পরমতা আর মৌলিকতা আছে তা দ্বিতীয়রহিত, কবির একান্ত নিজস্ব; অন্য কবিতায় তার উৎস খুঁজতে যাওয়া একধরনের ছিদ্রাণ্বেষণেরই শামিল। আর এসব অন্য গুণাবলির জন্যই হয়তো ১৯৫৩ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলনে ১৯৫২-র শ্রেষ্ঠ কাব্যের স্বীকৃতি লাভ করে 'বনলতা সেন'। জীবদ্দশায় এই একটি পুরস্কার পেয়েছিলেন কবি, এই 'বনলতা সেন'-রই জন্য।
এযাবৎ ইংরেজি, ফরাসিসহ বিভিন্ন ভারতীয় ও বিদেশি ভাষায় 'বনলতা সেন'-এর বহু অনুবাদ হয়েছে। শুধু ইংরেজিতেই হয়েছে বেশ কয়েকটি অনুবাদ। কবি নিজেও করেছিলেন একটি। আর করেছেন মার্টিন কার্কম্যান, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, ক্লিনটন বি. সিলি প্রমুখ। বাংলাদেশে 'বনলতা সেন'-এর উল্লেখযোগ্য ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ড. ফকরুল আলম।
রহস্যময়তা, সৌন্দর্য আর কবির গভীর অনুভব কবিতাটিকে এমন এক চূড়ায় পেঁৗছে দিয়েছে যে বনলতা সেন হয়ে উঠেছেন চিরকালের নারী, চিরসুন্দরী, অক্ষয়-অমর এক চিরপ্রার্থিত প্রেমিকা। এমন যার অবস্থান, সেখানে বনলতা বলে সত্যিই কেউ ছিল কি না, কী দরকার তার রহস্য উন্মোচনের? বরং চির অটুট থাক তার আবেদন ও সৌন্দর্য।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক।
'বনলতা সেন : ষাট বছরের পাঠ' বইয়ের সম্পাদক।
ই-মেইল: saikathabib@gmail.com

No comments:

Post a Comment