
আমরা কয়েক বন্ধু নাটকের কবি সেলিম আল দীনের সঙ্গে নাটোর গিয়েছিলাম নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে। গাড়ি যখন নাটোরের রাস্তায় ঢুকছে তখন চুপ হয়ে যাই সবাই। নাটোর প্রবেশের আগে সেলিম আল দীন বলছিলেন, নিজের মনকে কতটুকু বোঝ? সবটুকু বোঝার ব্যাকুলতা দরকার। না বুঝতে পারা অংশের মূল্যও কিন্তু কম নয়। আমাদের একজন বলছিল, কবিতার পঙক্তির মধ্যের অব্যক্ত অনুভূতিই আসল কবিতা। আমরা বিভিন্ন রকম তর্ক তুলেছিলাম। কিন্তু নাটোরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের একধরনের নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছিল। হয়তো অন্ধকারের পর্দার কথা চিন্তা করছিলাম কেউ কেউ। একজন বলছিল, এ যে সময়ের পর্দা। এই পর্দা দেখেছি রবীন্দ্রনাথের হঠাৎ দেখা কবিতায় 'মনে হল, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব/ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চারদিকে'। আর জীবনানন্দ দীর্ঘদিন পরে দেখা প্রেমিকাকে শাড়ির কালো রঙ দিয়ে নয়, ঘনিয়ে আসা 'অন্ধকার' দিয়েই তৈরি করেছেন সময়ের পর্দা। রবীন্দ্রনাথ স্টেশন আর ট্রেনের প্রতীকে, জীবনানন্দ অখ্যাত এক মহকুমা শহর নাটোরকে শ্রাবস্তীর সীমা-অসীমের ব্যঞ্জনায় ইতিহাসের নগরী করে তুলেছেন। প্রেমিকার কাছে যাওয়ার পথ নির্মাণ করেছেন ইতিহাসের পথে_প্রেম চিরকালীন একই বয়সী প্রমাণের জন্যে। হাজার হাজার বছর ধরে যে মানবযাত্রা চলছে, তারই সর্বাঙ্গীণ মহাযাত্রায় নবজন্ম 'আমি' এবং 'বনলতা সেনের'। পদবীসহ নায়িকার উপস্থিতি মনে করিয়ে দেয় পৌরাণিক সব নায়িকার কথা_রাধা, দ্রৌপদী, সীতা, ভেনাস, আফ্রোদিতি, ক্লিওপেট্রা, হেলেনের সঙ্গে আধুনিক মানসজগৎ জুড়ে থাকে আরেকটি নাম 'বনলতা সেন'। আমাদের নিস্তব্ধতার পর্দা ছিঁড়ে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?' মনের মধ্যে তখন অনেক প্রশ্ন। নাটোর রাজবাড়ির বালবিধবা 'বনলতা' আসলেই কি অমন আলাভোলা কবিকে ভালোবেসেছিলেন? শুনেছি, জীবনানন্দ বরিশাল থেকে বেশ কয়েকবার নাটোরে গিয়েছিলেন। ব্রহ্মধর্ম চর্চাকালীন পিতৃদেবের সঙ্গে কিশোর জীবনানন্দের নাটোরে আগমন ঘটেছিল কি না, সেসব জানার দরকারইবা কতটুকু? তবে রাজবাড়ির চিলেকোঠায় ইউরিপিদিস নাটকের হেলেনের মতো বনলতা সেনও কি পালাতে চেয়েছিল (প্যারিসের) জীবনানন্দের হাত ধরে? নাকি সবই কল্পগল্প। যেমন বলেছেন অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান, দু'দণ্ড শান্তি দিতে পারে কেবলমাত্র পতিতারাই। এ কথা ভুললে চলবে না, আধুনিকতার জন্ম সংশয়, ক্লান্তি আর নিরাশার মধ্যে আশা আর বিস্ময়ের সংগীতকে বহন করে। আধুনিক নারী, 'প্রেমিককে' দুদণ্ড শান্তি দিতে পারেন_এতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
তিন স্তবকের মূল ১৮ লাইনের কবিতায় ফেরা যাক, প্রথম স্তবকে আত্মপরিচয়, দ্বিতীয় স্তবকে দয়িতা বা প্রেমিকার রূপ ও শরীর সম্বন্ধীয় আত্বিক উপমা, তৃতীয় স্তবকে পরিণাম ও সত্য উদ্ঘাটন।
বোদলেয়ারের একটি প্রবন্ধের শুরু ও have memories more than thousand years. অর্থাৎ, আমি হাজার বছর ধরে আমার স্মৃতি বহন করে চলছি, তেমনি জীবনানন্দ যখন প্রথম ছয় লাইনের প্রথম লাইনে বলেন, 'হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে', তখন এই 'আমি'র স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে হয় প্রথমেই_
১. পাঠক অর্থাৎ যিনি পড়ছেন তিনি
২. কবি নিজে (জীবনানন্দ)
৩. প্রেমিক 'আমি'
৪. বোদলেয়ার কথিত ঐতিহাসিক ও জীনের ধারাবাহিকতায় সৃষ্ট 'আমি'
৫. সর্বভারতীয় 'আমি'
৬. ঔপনিবেশিক 'আমি'
৭. বিশ্বসভার এই 'আমি'
প্রথম স্তবকের আত্মপরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখতে পাই, ঔপনিবেশিক ভারতের মর্যাদাকর সেসব দিনের ও রাজ-রাজড়াদের কথা; যা প্রেমিকার একেকটি অঙ্গের বর্ণনায় দ্বিতীয় স্তবকেও কী চমৎকার চিত্রকল্প ও অনুপ্রাসের মধ্য দিয়ে সাজিয়েছেন। এ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার আগে ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক স্থান ও নামের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দিচ্ছি পাঠকের সুবিধার্থে। যা কবিতার পরতে পরতে অস্থি-মজ্জার মতো ছড়িয়ে আছে।
বিম্বিসার_১০০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতের ১৬টি জনপদের মধ্যে স্বতন্ত্ররাজ্য ছিল মগধ। এ মগধ রাজ্যের অন্যতম রাজা বিম্বিসার।
বিদর্ভনগর_মুণিবিশেষের অভিসম্পাতগ্রস্ত স্থান। পুরাণে বর্ণিত আছে, কুশাঘাতে কোনো এক ঋষি কুমারের এই স্থানে অকালমৃত্যু হওয়ায় ওই ঋষি এ দেশে আর দর্ভ জন্মাবে না বলে শাপ দেন। সেই থেকে এই স্থানের নাম হয় বিদর্ভ। আধুনিক বেরার নগরী।
অশোক_চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আলেকজান্ডারের আক্রমণের পর সর্বভারতীয় ঐক্যবোধের চেতনা বিস্তার করেন এবং মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। চন্দ্রগুপ্তের ছেলে বিন্দুসার, বিন্দুসারের পুত্র অশোক ২৭৩_২২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যার রাজত্ব ছিল। ২৬০ অব্দে কলিঙ্গ যুদ্ধে লক্ষাধিক প্রাণ সংহারের পর তিনি অনুশোচনায় বুদ্ধধর্ম অবলম্বন করেন এবং রাজ্য বিস্তার করেন।
বিদিশা_প্রাচীন ভারতে শুঙ্গ যুগের নগরী। উত্তর-দক্ষিণ ভারতের হিন্দু চেতনার আলোকে বিভিন্ন মন্দির ও ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছিল এখানে।
শ্রাবস্তী_শ্রাবস্তী প্রাচীন ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি নগরী। বৌদ্ধকেন্দ্রিক ভাস্কর্য শিল্পের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। এটি বুদ্ধের জন্মস্থান নেপালের লুম্বিনি গ্রামের কাছে অবস্থিত।
বিভূতিভূষণ তাঁর 'শেষ লেখা' গল্পে নারীর যে রূপ বর্ণনা করেছেন, তা যেন এই বনলতা সেনেই সব প্রতীয়মান। তিনি লিখেছিলেন,'ওই একখানি রূপের মধ্যে সারা পৃথিবীর রূপের মঞ্জুষা।' যাঁরা এডগার এলান পোর to helen কবিতার সঙ্গে বনলতা সেনের মিল খোঁজেন, তাঁদের দেখা উচিত the hyacinth hair আর 'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা', এর মধ্যে কত তফাৎ। আবার the classic face... এর সঙ্গে 'মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য'_কোথায় এক পৌরাণিক জগতের সঙ্গে চিত্রময়তা আর এলান পোর সাধারণ উপমা একদম মেলে না, চলে না এ সব তুলনা। কারণ এলান পো শুধু শারীরিক বর্ণনার আদিরস খুঁজেছেন তাঁর to helen কবিতায়, যা পদ্মাবতীতে আমরা পাই, জীবনানন্দ একেবারেই ভিন্ন। যেখানে helen -এর সৌন্দর্যই প্রধান আর বনলতা সেনে হাজার বছরের ইতিহাস পরিক্রমায় জিনানুক্রমিক চিরায়ত প্রেমের সর্বকালীন সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটেছে। যাঁর চরণ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, 'এক একটি উপমাই এক একটি ছোট কবিতা হতে পারতো।' আসলেই তাই পুরাণ আর ইতিহাসের অলংকার দিয়ে সাজানো বনলতার শরীরের ভূষণ জীবনানন্দ দ্বিতীয় স্তবকে যেভাবে সাজিয়েছেন, তাতে উপরিউক্ত মন্তব্য ভুল বলে মনে হয় না। প্রথমে 'চুল', দ্বিতীয় 'মুখ', তৃতীয় 'চোখের' চিত্রকল্প আঁকতে গিয়ে তিনি যখন বলেন, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?/পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।' এই যে পাখির নীড় শান্তির প্রতীককে চিত্রকল্প করা যায়, তা আবার প্রেমিকার চোখকে উদ্দেশ করে, তা আমরা জীবনানন্দের পূর্ববতী কারো কবিতায় দেখতে পাই না। আমরা রবীন্দ্রনাথের 'রক্তকরবী' নাটকে বিশুকে উদ্দেশ করে 'নন্দিনী'কে বলতে শুনি_'...যাবার সময় কেমন করে আমার মুখের দিকে তাকালে_বুঝতে পারলুম না_তারপর কতকাল খোঁজ পাইনি। কোথায় তুমি গেলে বলোতো!' 'রক্তকরবী'তে 'নন্দিনী'র ভেতর-বাইরে রঞ্জনের নিবিড় সাহসী উপস্থিতি আছে কিন্তু বনলতা সেনে এই যে 'আমি'র দুদণ্ড প্রশান্তি যেখানে শেষ লাইনে, 'থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন'_এই অন্ধকার ইতিহাস-সৃজিত সৌন্দর্য, যা 'হঠাৎ দেখা' to helen কিংবা 'রক্তকরবী'তে নেই।
একই সঙ্গে চিরায়ত প্রেমের সমকালীন অনুভূতি, ঔপনিবেশিক অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ, 'আপনি' সম্বোধনের মধ্য দিয়ে আপাত প্রেম প্রত্যাখ্যানের নান্দনিক উপস্থাপন, সর্বভারতীয় প্রেমিকের প্রতীক হয়ে আমাদের মননে স্থায়ী আসন তৈরি করে, যা চিরন্তন প্রেমেরই প্রতিচ্ছবি হয়ে আত্মজিজ্ঞাসায় নিয়ত অনুরণিত হয়_'এতদিন কোথায় ছিলেন?'
(সংখ্যা-১০, ১৯ মার্চ ২০১০)
Source: Daily Kalerkantho, 31th Dec, 2010
No comments:
Post a Comment