বনলতা সেন
বনলতা সেন জনপ্রিয়তম বাংলা কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কবিতাটির রচয়িতা বিংশ শতাব্দীর আধুনিক বাঙ্গালী কবি জীবনানন্দ দাশ। প্রধানত একটি রোমান্টিক গীতি কবিতা হিসেবেই এটি সমাদৃত। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে কবির জন্ম শতবার্ষিকীতে ঢাকা শহরের ১০০০ জন কলেজ ছাত্রের মধ্যে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে তাদের সকলেই (১০০ ভাগ) কবিতাটি সম্পর্কে অবহিত এবং ৯৮৮ জন কবিতাটি অন্ততঃ একবার পাঠ করেছে। তদুপরি ২১৯ জন নির্ভুলভাবে কবিতাটি মুখস্থ বলতে পেরেছে।
রচনা-প্রকাশের ইতিহাস
জীবনানন্দ দাশের "বনলতা সেন" কবিতাটি প্রথম প্রকাশ করেছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতা পত্রিকায়, পৌষ ১৩৪২ সংখ্যায় (ডিসেম্বর, ১৯৩৫)। জীবনানন্দ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর বনলতা সেন নামীয় তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে এটি অন্তর্ভুক্ত করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থটিতেও এ কবিতাটি সংকলতি হয়। এছাড়া আবু সায়ীদ আইয়ুব এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের যেৌথ সম্পাদনায় ১৯৩৯ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত আধুনিক বাঙলা কবিতা শীর্ষক গ্রন্থেও কবিতাটি সংকলিত হয়েছিল। কোলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে সুরক্ষিত পাণ্ডুলিপিসমূহের ১৯৩৪ খৃস্টাব্দ চিহ্নিত ৮ নং খাতায় এ কবিতাটি আছে। তাই, পাণ্ডুলিপির হিসেবে, ১৯৩৪ খৃস্টাব্দে কবিতাটি লিখিত হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। এ সময় সিটি কলেজ-এ টিউটরের চাকুরী হারিয়ে বেকার জীবনানন্দ সম্পূর্ণ নিঃসহায় অবস্থায় কোলকাতায় দিনাতিপাত করছিলেন। মাত্র কয়েক বৎসর আগে বিয়ে হয়েছিল, স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা হবে না কোনওদিন তা ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল।[১] কবিতাটির সঠিক পাঠ নিয়ে প্রশ্ন আছে ; কেননা ভিন্ন ভিন্ন সংকলনে ভিন্ন ভিন্ন পাঠ পাওয়া যায় যদিও সে সবের পার্থক্য ব্যাপক কিছু নয়। তবে ভূমেন্ত্র গুহ সম্পাদিত পাণ্ডুলিপির কবিতা শীর্ষক গ্রন্থের পাঠটি নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়।
শিরোনাম
আপাতঃ দৃষ্টিতে 'বনলতা সেন' একটি প্রেমের কবিতা যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বনলতা সেন নামীয় একটি রমণীর স্মৃতি রোমন্থন। শুরু থেকেই পাঠকের কেৌতূহল বনলতা সেন কি বাস্তবের কোন নারী নাকি সম্পূর্ণ কল্পিত একটি কাব্যচরিত্র। এ কবিতার তিনটি স্তবকের প্রতিটির শেষ চরণে বনলতা সেন নামীয় এক নারীর উল্লেখ আছে।
- প্রথম স্তবকের শেষ চরণঃ "আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন" ;
- দ্বিতীয় স্তবকের শেষ চরণঃ "পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন" ; এবং
- তৃতীয় স্তবকের শেষ চরণঃ "থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন" ।
বনলতা সেন ছাড়াও জীবনানন্দের কাব্যে বেশ কিছু নারী চরিত্রের উপস্থিতি আছে ; যেমন শ্যামলী, সুরঞ্জনা, সুচেতনা, সরোজনী, শেফালিকা বোস, সুজাতা ও অমিতা সেন। তবে ১৯৩২ খৃস্টাব্দে লিখিত এবং প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল অন্তরালবাসী কারুবাসনা নামীয় উপন্যাসে প্রথম 'বনলতা সেন' নামটি পাওয়া যায়। অধিকন্তু 'হাজার বছর ধরে খেলা করে', 'একটি পুরোনো কবিতা' এবং 'বাঙালি পাঞ্জাবী মারাঠি গুজরাটি' শীর্ষক আরও তিনটি কবিতায় এ নামটি আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে কারুবাসনা উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ খৃস্টাব্দে, কবির মৃত্যুর বহুকাল পর। এর ভাষা-ভঙ্গিতে অনবগুণ্ঠিত আত্মজৈবনিকতা সেকালের পাঠক মনে বিশেষ কৌতূহলের উদ্রেক করেছিল। বনলতা সেন রক্ত মাংসের কোনও মানবী না-কি নিছকই কল্পিত কোনও কবিতা-নারী এ প্রশ্নটি অবসিত না-হলেও রহস্যের কিনারা হয়েছে কিছু। ২০০৭ খৃস্টাব্দে জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপি উদ্ধারক ডা. ভূমেন্দ গুহ কবির 'লিটেরেরি নোটস' গবেষণা করে জানিয়েছেন যে কবির জীবনে প্রেম এসেছিল সন্দেহ নেই। দিনলিপি বা লিটেরেরী নোটস-এ ওয়াই (Y) হিসেবে উল্লিখিত মেয়েটিই কবির কাঙ্ক্ষিত নারী। বাস্তবে সে শোভনা - কবির এক কাকা অতুলান্ত দাশের মেয়ে - যার ঘরোয়া নাম বেবী। ১৯৩০ খৃস্টাব্দে লাবণ্য দাশকে বিয়ের আগেই এই বালিকার প্রতি যুবক জীবনানন্দ গভীর অনুরাগ অনুভব করেছিলেন। একটি উপন্যাসে শচী নামেও একে দেখতে পাওয়া যায়। শোভনাকে নিয়ে জীবনানন্দের অনুরাগ উন্নীত হয়েছে অনুক্ত প্রেমে ; লাবণ্য দাশের সঙ্গে দাম্পত্যজীবন আদৌ সুখকর না-হওয়ায় এই প্রেম তীব্রতর হয়ে ক্রমশ এক প্রকার অভিভূতিতে পর্যবসিত হয়েছিল।
কাঠামা এবং রচনা কৌশল
নাতিদীর্ঘ আঠারো পংক্তির নিরেট স্থাপত্যের এই গীতিকবিতায় রয়েছে ছয় পংক্তির তিনটি স্তবক। প্রথম স্তবকে কবি মূলত নিজের কথা বলেছেন ; দ্বিতীয় স্তবকে বলেছেন এক ঝলক দেখা প্রিয় মুখের কথা এবং তৃতীয় স্তবকে বলেছেন একটি স্বপ্নের কথা। কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ছন্দ অক্ষরবৃত্ত বা পয়ারে রচিত। তবে পর্ব বিন্যাসে সমতা রক্ষা করা হয় নি।
প্রথম স্তবকের প্রতি পংক্তি তিন পর্বের যার মাত্রা বিন্যাস ৮+৮+৬। ৮ মাত্রার একটি পর্ব মধ্যভাগে থাকার কারণে এ স্তবকের ছন্দবিন্যাসকে মহাপয়ার পর্যায়ী বলা যায়।
দ্বিতীয় স্তবকে বিভিন্ন পংক্তির পর্ব বিন্যাস বিভিন্ন ; যেমনঃ ৮+৮+২; ৪+৮+১০; ৮+৬, ৮+৮+১০; ৮+৪+৪+১০ এবং ৮+৪+১০।
তৃতীয় স্তবকের পর্ব ও মাত্রা বিন্যাস এরকমঃ ৮+১০; ৪+৮+৬; ৮+৪+১০; ৮+১০; ৮+৪+৮+৬ এবং ৮+৮+৬। পয়ারে বা অক্ষরবৃত্তের এরূপ সূত্রহীন ব্যবহার সত্বেও কবিতাটির সঙ্গীতময়তা অতুলনীয়। এ কারণে অনুমিত হয় যে শব্দবিন্যাস এদিক-সেদিক করে কবিতাটির সঠিক পর্ববিন্যাস নির্ণয় করা আবশ্যক।
অর্থক্রম
কবিতাটির প্রথম স্তবকে হাজার বছর ব্যাপী ক্লান্তিকর এক ভ্রমণের কথা বয়ান করেছেন কবিঃ তিনি হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে ফিরেছেন ;- যার যাত্রাপথ সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগর অবধি পরিব্যাপ্ত। তার উপস্থিতি ছিল বিম্বিসার অশোকের জগতে যার স্মৃতি আজ ধূসর। এমনকী আরো দূরবর্তী বিদর্ভনাটোরের বনলতা সেন। নগরেও স্বীয় উপস্থিতির কথা জানাচ্ছেন কবি। এই পরিব্যাপ্ত ভ্রমণ তাকে দিয়েছে অপরিসীম ক্লান্তি। এই ক্লান্তিময় অস্তিত্বের মধ্যে অল্প সময়ের জন্য শান্তির ঝলক নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল বনলতা সেন নামীয় রমণী। কবি জানাচ্ছেন সে
কবিতাটির দ্বিতীয় স্তবকে বনলতা সেনের আশ্চর্য নান্দনিক বর্ণনা দিয়েছেন কবি। বনলতা সেন-কে কবি প্রত্যক্ষ করেছেন অন্ধকারে। তার কেশরাজি সম্পর্কে কবি লিখেছেনঃ "চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা" ; মুখায়বব প্রতীয়মান হয়েছে শ্রাবস্তীর কারুকার্যের মতো। বনলতাকে দেখে গভীর সমুদ্রে হাল-ভাঙ্গা জাহাজের দিশেহারা নাবিকের উদ্ধারলাভের অনুভূতি হয়েছে কবির, যেন একটি সবুজ ঘাসের দারূচিনি দ্বীপ সহসা ঐ নাবিকের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বনলতা সেনও তার পাখির নীড়ের মতো আশ্রয়ময় চোখ দুটি তুলে জানতে চেয়েছে, "এতদিন কোথায় ছিলেন?"
তৃতীয় স্তবকটি স্তগতোক্তির মতো মৃদু উচ্চারণে একটি স্বপ্ন-উণ্মোচনের কথা শোনা যায়। কবি জানাচ্ছেন (হেমন্তের)দিন শেষ হয়ে গেলে সন্ধ্যা আসে, ধীরে, ধীরলয়ে শিশিরপাতের টুপটাপ শব্দের মতো। তখন (দিনভর আকাশচারী)চিলের ডানা থেকে রোদের গন্ধ মুছে যায়। এ সময় পাখিদের ঘরে ফিরে আসার তাড়া ; এসময় (যেন) সব নদীরও ঘরে ফেরার ব্যাকুলতা। পৃথিবীর সব আলো মুছে যায় ; অন্ধকারে কেবল কয়েকটি জোনাকি জ্বলে। সারাদিনের জাগতিক সব লেনদেন সমাপ্ত হয়েছে; গল্পের পাণ্ডুলিপি তৈরি ; তখন (কেবল) অন্ধকারে বনলতা সেনের মুখোমুখি বসে গল্প করার অবসর।
সাহিত্যালোচনা
'বনলতা সেন' কবিতাটি সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বহুল পঠিত কবিতাগুলোর একটি। জীবনানন্দের বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার বেশ আগেই কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল। অথচ শেষ দিককার কবিতায় যে-দুর্গম সান্ধ্যভাষা পরিলক্ষিত হয় এ কবিতায়ও তা অনুপস্থিত নয়। কিন্তু এমন-ই এক দুর্মর রোমান্টিকতা কবিতাটির অবয়বে পরিব্যাপ্ত যা পাঠককে সহজে আচ্ছন্ন করে; ফলে কবিতাটির আন্তর্ভাষ্য নিয়ে চিন্তার প্রণোদনা পাঠকের হৃদয়ে সহজে প্রশ্রয় লাভ করে না। সাধারণ পাঠকের কাছে এটি নিছকই একটি প্রেমের কবিতা হিসেবে সমাদৃত হয়েছে ; অথচ এর মর্মমূলে রয়েছে সুগভীর ঐতিহাসিকতা।
পোর টু হেলেন এর সঙ্গে সাযুজ্য
এ কবিতাটির বিভিন্ন আলোচনায় বলা হয়েছে যে এডগার এলেন পো'র 'টু হেলেন' (বাং: হেলেনের প্রতি) কবিতাটির সঙ্গে 'বনলতা সেন' কবিতাটির বিষয়গত সাদৃশ রয়েছে, যা থেকে প্রতীয়মান হয় জীবনানন্দ দাশ এই কবিতাটি পড়ে 'বনলতা সেন' কবিতাটি রচনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তবে 'বনলতা সেন' এবং 'টু হেলেন' মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে তাও বিবেচনা করা হয়েছে।
অনুবাদ
সেই পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে আজ অবধি নানা হাতে ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি বহুবার অনুদিত হয়েছে। প্রথম অনুবাদটি করেছিলেন মার্টিন কার্কম্যান, যা একটি কবিতা সংকলনে গৃহীত হয়েছিল।। অব্যবহিত পরেই কবি নিজে করেছেন এর অনুবাদ। আরও যাদের হাতে কবিতাটি অনূদিত হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন সনৎ ভট্টাচার্য, পুরুষোত্তম লাল ও শ্যামশ্রী দেবী, ম্যারি ল্যাগো (তরুণ গুপ্তর সহযোগে), চিদানন্দ দাশগুপ্ত, হায়াৎ সাইফ, মুকুল শর্মা, ক্লিনটন সিলি, আনন্দ লাল, সুকান্ত চৌধুরী, ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, অনুপম ব্যানার্জি, অঞ্জন বসু, ফখরুল আলম, জো উইন্টার, অরুণ সরকার, ডি কে ব্যানার্জি, অমিতাভ মুখার্জি এবং জয়দেব ভট্টাচার্য। অনুবাদগুলো পাঠ করলে অনুবাদকদের উপলব্ধির প্রভেদ এবং অর্থায়নের ভিন্নতা প্রতিভাসিত হয়। সুজিত মুখার্জ্জি তার ট্রান্সলেশন এজ ডিসকভারী (১৯৯৪) শীর্ষক গ্রন্থে ৬টি অনুবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। [৩] জীবনানন্দ দাশ মার্টিন কার্কম্যানকৃত অনুবাদে "পাখির নীড়ের মতো চোখ" কথাটির আক্ষরিক অনুবাদে আপত্তি জানিয়েছিলেন। অধিকাংশ অনুবাদক প্রথম ছত্রের ("হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে") হাজার বছর ব্যাপী পথ চলাকে ঘটমান বর্তমান কাল হিসেবে অনুবাদ করেননি। তৃতীয় স্তবকের দুটি লাইন "পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন / তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল" এর মর্মার্থ রূপায়নে সক্ষম হননি অনেক অনুবাদক। "পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন" বা "গল্পের তরে" কথার অর্থ স্বতঃস্ফুট নয়।
No comments:
Post a Comment